ছোট্ট পায়ে অল্প দূরে

টেরাকোটার কাজের মন্দির।

প্রবাসী অর্থাৎ পরবাসে যাঁরা থাকেন বাংলাভাষী যেহেতু তাই ধরেই নেওয়া যায় কোন না কোন সূত্রে তাঁদের যোগ পশ্চিমবঙ্গের সাথে আছে। বছর দুবছরে কাজের ফাঁকে ঘরের টানে হয়তবা দিনকয়েক এর ছুটি নিয়ে নিজবাসে আসেন। তখন রোজের পরিসরের বাইরে, এদিক ওদিক ঘুরতে যেতে মন চায়।দিনে গিয়ে দিনেই ফেরার হদিশ পেলে নিশ্চয় মন্দ হয় না, কি বলেন?

তাহলে চলুন আজকে সেই রকমই এক জায়গার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি।

হুগলী জেলার তারকেশ্বর এর নাম শৈব তীর্থের জন্য বহুল পরিচিত। কিন্তু এই পথেই যেতে গিয়ে হরিপাল স্টেশন থেকে রাস্তা ভাগ হয়ে গিয়ে বাম দিক ধরলেই পৌঁছে যাওয়া যায় এক প্রাচীন জনপদে।

নাম তার আঁটপুর। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে মিত্র বংশের হাত ধরে শুরু হয় এই স্থানের উন্নতি। কৃষ্ণরাম মিত্র ছিলেন সেই সময়ে বর্ধমান রাজার দেওয়ান। নিজ বুদ্ধিবলে অর্থ উপার্জন করেছিলেন প্রচুর। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন শাক্ত ধর্মীয়। কিন্তু এক সন্ন্যাসী তাঁকে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি দিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দেন। সেই আদেশ মেনেই তিনি তৈরী করেন টেরাকোটার কাজ করা দোচালা মন্দির যা সারা বাংলা য় দ্বিতীয় বৃহত্তম টেরাকোটার মন্দির। প্রথমটি অবশ্যই বিষ্ণুপুরের। মন্দিরের সামনের দিকে রামায়ন-মহাভারত-বানিজ্য তরীর চিত্র টেরাকোটার ব্লকে করা। মন্দিরের ভেতরের দেয়ালে ও ছাদ জুড়ে আছে একশো আটটি পদ্মের ব্লক যার প্রতিটি ফুলের গঠন আলাদা। এই বংশের বর্তমান প্রজন্মের একজনের সঙ্গে মন্দির চত্ত্বরেই কথা হচ্ছিল যার কাছে জানলাম এই টেরাকোটার প্যানেল গুলি গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি। তাই এর রক্ষনাবেক্ষণ বেশ ব্যায় সাপেক্ষ। মিত্র বং

মূল মন্দিরের ছাদের কাজ

শের বাড়ির আঙ্গিনায় আছে টেরাকোটার কাজ করা দুটি শিব মন্দির ও দোল মঞ্চ।

আর আছে কাঁঠাল কাঠের ফ্রেমে করা আটচালা চন্ডী মন্ডপ ও। এটি রাধামাধব মন্দিরের চেয়ে ও পুরাতন।

আঁটপুরের মিত্র বাড়ির সীমানা ছাড়ালেই শুরু হবে ঘোষদের বাড়ি যা আজ আঁটপুর রামকৃষ্ণ মিশন নামেই অধিক পরিচিত। এটি স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজ, যিনি রামকৃষ্ণ দেবে র সাক্ষাৎ শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম, তাঁর বসত ভিটা। সন্ন্যাস পূর্বে নাম ছিল বাবুরাম ঘোষ। এই বাড়ি শ্রীশ্রী সারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দের পদধূলি ধন্য। এখানেই ১৮৮৭সালের ২৪ডিসেম্বর রাতে রামকৃষ্ণ দেবের নয়জন শিষ্য একত্রে সংসার ত্যাগের সংকল্প নেন।

কাঁঠাল কাঠের আটচালা র চন্ডীমন্ডপ

আঁটপুরের মিত্র-ঘোষ বাড়ির পরিধি ছাড়িয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে মিনিট পাঁচেক গিয়ে বাম হাতে একটি রাস্তা ঢুকে যাচ্ছে পল্লীর ভিতর। সেই রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে ডানদিকে বেঁকে এগিয়ে গেলে পড়বে ‘শ্যামের পাট’। এটি শ্রীচৈতন্যদেব এর পার্ষদ পরমেশ্বরী দাসের জন্মভিটা। এখানে মদন মোহন বিগ্রহ ও সেই সঙ্গে মহাপ্রভুর পদচিহ্ন রাখা আছে। আর আছে শতাধিক প্রাচীন এক বুকুল গাছ।

আঁটপুরের দর্শনীয় স্থান গুলি ঘোরা হলে আরও পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে সোজা রাস্তায় গেলে পড়বে রাজবলহাট। হুগলী জেলার প্রসিদ্ধ এই জনপদ মূলতঃ বিখ্যাত দুটি কারণে। এইস্থানের প্রধান আরাধ্য দেবী রাজবল্লভী মা, তাঁর নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম আর দ্বিতীয় হল এখানকার তাঁতে বোনা বাংলার শাড়ি।

রাজবল্লভী মাতার মন্দির প্রাঙ্গন এ পুন্যতিথি ও ছুটির দিন বেশ ভিড় হয়।

রাজা সদানন্দ রায় কতৃক প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটি মূর্তি সহ প্রায় আটশো বছরের প্রাচীন। দেবী শ্বেতবর্ণা, দ্বিভূজা, স্থানীয় মানুষদের কাছে দেবী জাগ্রতা বলেই বিশ্বাস। মন্দির প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে আঁটপুরের দিকে আসতে বাম হাতে পড়বে ভারত সেবাশ্রম সংঘ। হাতে সময় থাকলে দেখে নেওয়া যেতেই পারে। মূল মন্দিরের আশেপাশে সুন্দর বাগান ও বাঁধানো দিঘীর ধারে নিরালায় বেশ কিছুক্ষণ বসতে ভালোই লাগে।

শ্যামের পাট

#কিভাবে যাবেন- হাওড়া থেকে তারকেশ্বরগামী ট্রেনে হরিপাল স্টেশনে নেমে টোটো ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে সারাদিনের জন্য। তবে কলকাতা থেকে সড়কপথে ষাট কিলোমিটার প্রায়। নিজস্ব গাড়িতে আসলে সকাল সাতটায় বেরিয়ে বেলা সাড়ে আটটা-নয়টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে আঁটপুর।

#কিভাবে ঘুরবেন- একদমই গ্রাম্য এলাকা। খাবার হোটেল বিশেষ পাবেন না। অথচ সারাদিনের ঘোরাঘুরি। তাই পৌঁছেই প্রথমে আঁটপুর রামকৃষ্ণ মিশনের দুপুরের খাবারের কুপনটা করে নিন। সকাল দশটার পর কিন্তু আর কুপন বিক্রি হয়না।

রাজবল্লভী মা রাজবলহাট

এর পর মিশনের মন্দির, মিত্রদের মন্দির, শ্যামে র পাট ঘুরে নিন। তারপর ঠিক বেলা বারোটার সময় ফেরত আসুন মিশন প্রাঙ্গনে। দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে চলে যান রাজবলহাটে রাজবল্লভী মাতার দর্শনে। হাতে থাকা সময় অনুযায়ী রাজবলহাট ঘুরে, ইচ্ছে হলে তাঁতের সম্ভার দেখে ফিরে চলুন বাড়ির পথে।

আর হ্যাঁ রাজবলহাটের মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা খেতে ভুলবেন না। এইরকম টাটকা ছানার মিষ্টি কিন্তু শহরে সহজে মেলে না।

#কি কি করবেন না- টেরাকোটার মন্দিরের প্যানেলে হাত দেবেন না। গঙ্গামাটির তৈরী আর শত বছরের পুরনো তাই সহজেই ভেঙে যাচ্ছে। মন্দিরের ভেতরে বর্তমানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। সেই নির্দেশ অমান্য না করাই ভালো।আর পথে ঘাটে প্লাস্টিক অবশ্যই ছড়িয়ে আসবেন না। আমাদের সামান্য সচেতনতা পরিবেশকে অনেক খানি সুন্দর রাখে।

Comments
  1. সুজাতা শীল
  2. pamolas2009@gmail.com' Poulami Sarkar
  3. Sanistha Basu
  4. Tanya Sengupta

Leave a Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *